বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:০০ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বাইডেনের জয় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী:

স্বাধীনতা-উত্তরকালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। বর্তমানে আমাদের রপ্তানির সবচেয়ে বড় একক বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। এছাড়া আমাদের অভিবাসীদের একটা বড় অংশ থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তারা একদম সাধারণ পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপদে আসীন আছেন। বিশেষ করে গবেষণা থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা সফলতা লাভ করেছেন। একই সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনেও বাংলাদেশি অভিবাসীরা অংশগ্রহণ করছেন। মোটকথা, তারা সেখানে নিজেদের একটা শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। ওয়াশিংটনে যে সরকারই আসুক না কেন বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকবে এবং প্রতি বছরই তা আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে।

তবে গত ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও ভিসা প্রক্রিয়াতে বেশ কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। আশা করা যাচ্ছে, নতুন মার্কিন প্রশাসন কাজ শুরু করলে এই সমস্যাগুলো কেটে যাবে। কারণ, ডেমোক্রেটিক পার্টি তথা জো বাইডেনের লক্ষ্য হচ্ছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা। দুঃখজনকভাবে গত চার বছরে ট্রাম্প প্রশাসন ‘আমেরিকা ফার্স্ট ’ বা ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি অনুসরণ করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রায় নষ্টই করেছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়া এ অঞ্চলে আমেরিকার অবস্থান শক্ত ছিল না। ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষের কারণে কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি সমঝোতা থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে এসেছিলেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি কমেনি; বরং বেড়েছে। তার ইসরায়েল তোষণনীতি ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। বরং জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং মার্কিন দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের হাতকে আরও শক্তিশালী করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের মুখে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হয়েছে এবং এর ফলে মুসলিম বিশে^ একটা বড় ধরনের হতাশা ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। বাইডেন ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হলেও বড় কোনো ধরনের পরিবর্তন আনতে পারবেন না।

জো বাইডেন তার বিজয়ী ভাষণে বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এ থেকে ধারণা করা যায় তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেবেন। এছাড়া তার রানিংমেট এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ধমনিতে ভারতীয় উপমহাদেশের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণেই ধারণা করা যাচ্ছে, নতুন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নতি হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ওবামা প্রশাসনের সময় থেকে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। জো বাইডেনের প্রশাসনেও এ নীতি অব্যাহত থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে। কারণ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাতে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত অবস্থানে আছে। সুতরাং, নতুন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে অবশ্যই গুরুত্ব দেবে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ সুবিধাগুলো ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করলে এখন তা পাওয়া যেতে পারে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে আমেরিকান ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কড়াকড়ি ছিল সেটাও তুলে নেওয়া হবে বলে আশা করা যায়। আর এখন বাংলাদেশি ছাত্ররাও উচ্চশিক্ষা নিতে সহজেই যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবে। যেসব বাংলাদেশি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন, তাদের প্রতি নতুন প্রশাসন সহানুভূতিশীল আচরণ করবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশের ওপর চীনের ব্যাপক প্রভাব কমিয়ে আমাদের একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করবে মার্কিনিরা। এখন বাংলাদেশের সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় ৮০/৯০ ভাগই সরবরাহ করে চীন। চীনের প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো নিজেদের অত্যাধুনিক অস্ত্র অল্প দামে বা বিশেষ সুবিধায় বাংলাদেশকে হস্তান্তর করতে চাইবে। আশা করা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক ও প্রকৌশলগত সহযোগিতা করবে এবং এর ফলে দেশের আধুনিকায়নে একটা বড় উল্লম্ফন ঘটবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ যেন ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় অনুষ্ঠিত হতে থাকা বিভিন্ন সামরিক মহড়াগুলোতে অংশগ্রহণ করে।

বঙ্গোপসাগরে চীনের অবস্থান সুদৃঢ় হোক তা যুক্তরাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত নয়। এখানে চীনকে প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ একটা দরকষাকষির অবস্থানে যেতে পারে। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের চলমান সংকটে চীন মিয়ানমারের পক্ষই নিচ্ছে বলা যায়। ভারতও ‘লিপ সার্ভিস’ বাদে সত্যিকারের কোনো সাহায্য করছে না। বাইডেন প্রশাসন যদি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে তাহলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটা ইতিবাচক গতি আসতে পারে।

বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে স্বাক্ষরিত প্যারিস কপ-২১ চুক্তি থেকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছিলেন কিন্তু বাইডেন আবার সেখানে যোগদান করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ প্রাপ্য সাহায্য-সহযোগিতা পেতে পারে।

আবার, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তবে আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে আইএস, আল-কায়েদাসহ নানা জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্রুত আফগানিস্তান থেকে সরে যায় বা তাদের সৈন্যবাহিনীকে গুটিয়ে নিয়ে যায়, সেখানে উগ্র জঙ্গিবাদী সংগঠন আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আফগানিস্তানে জঙ্গি শাসন কায়েম হলে তার প্রভাব পুরো অঞ্চলের ওপর পড়বে। আমাদের বুঝতে হবে, যদি জেহাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণরা সিরিয়া যেতে পারে, তবে আফগানিস্তানে যাওয়া তাদের জন্য আরও সহজ হবে। আমার মনে হয় বাইডেন প্রশাসনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে যেভাবে তাড়াহুড়ো করে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করছিল সেটা হয়তো বাইডেন প্রশাসন পুনর্বিবেচনা করবে। সৈন্যরা ফিরে গেলে আফগানিস্তানে যাতে আল-কায়েদা বা এ ধরনের কোনো সংগঠনের ঘাঁটি গড়ে উঠতে না পারে নয়া মার্কিন প্রশাসন সে ব্যাপারে নজর দেবে, কারণ এ ধরনের সংগঠিত জঙ্গিবাদ পুরো উপমহাদেশের জন্য একটি নতুন সংকটের জন্ম দেবে।

অতীতে ভারতের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক সবসময়ই ভালো ছিল, বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে ভারতের আদর্শগত সম্পর্ক অত্যন্ত সুখকর ছিল। তবে এখন মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদ কায়েমের মাধ্যমে সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ সৃষ্টি ও নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করে নতুন মার্কিন সরকার সম্ভবত এ ব্যাপারে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কেননা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত কঠোর। ট্রাম্প যেভাবে মোদিকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ বা যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন বাইডেন তা দেবেন না। একই সঙ্গে বাংলাদেশে যেন সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয় সেদিকেও নতুন মার্কিন সরকার নজর রাখবে। এমনকি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও তারা বিভিন্ন সুপারিশ করতে পারে যা ট্রাম্পের সময় হয়নি।

জো বাইডেনের জয় আসলে গণতন্ত্রের জন্যই একটা বিরাট বিজয়। ট্রাম্প আমেরিকায় যে বিভেদের রাজনীতি করেছেন তা দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বা বিশ্ববাসী কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাইডেন ও তার রানিংমেট কমলা হ্যারিস নিজেদের উদ্বোধনী বক্তৃতায় মার্কিন জনগণকে গোত্র, বর্ণ ও মতামতের বিভেদ ভুলে এক পতাকার নিচে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা আরও বলেছেন, আগামী দিনগুলোতে তারা সবাইকে নিয়েই কাজ করবেন। আসলে এটাই হওয়া উচিত। এই বক্তব্য থেকে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিকদের অনেক কিছু জানার ও শেখার আছে।

আমি মনে করি, এখন গণতান্ত্রিক বিশ্বের সবার দৃষ্টি থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। বিশ্ব দেখতে চায় আগামী দিনগুলোতে কীভাবে জো বাইডেনের প্রশাসন এগিয়ে যাবে। তাছাড়া সারা বিশ্বেই বাইডেনের একটা ইতিবাচক ইমেজ আছে, পাশাপাশি বাংলাদেশেও তার প্রচুর জনসমর্থন আছে। আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও গভীর হবে এবং এ সম্পর্কের নতুন একটা উন্নয়নসূচক আমরা দেখতে পাব। প্রত্যাশা থাকবে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বাইডেন প্রশাসন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।সূত্র:দেশরূপান্তর।

লেখক নিরাপত্তা বিশ্লেষক; অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর; ট্রেজারার, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক

Ishfaq5156@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION